‘ক্রেতা সাবধান নীতি’ বলে বোঝায়, কিছু কেনার আগে ক্রেতাকে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, এ নীতি অনুসারে পণ্যের ত্রুটি প্রকাশ করতে বিক্রেতা বাধ্য নয়। যা কিনছেন, তা দেখে-শুনে-বুঝে নিতে হবে।
অনেকেই সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে স্থায়ী আবাসের স্বপ্ন দেখেন। চান নিজের ফ্ল্যাট কিংবা এক টুকরা জমি। আর এ জমি বা ফ্ল্যাট কেনার সময় অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত হওয়ার ভয় থাকে কিংবা নানা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। এ ক্ষেত্রে কী ধরনের আইনগত প্রস্তুতি গ্রহণ করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম।
তানজিম আল ইসলাম বলেন, ‘আইনের অজ্ঞতা কখনো অজুহাত হতে পারে না। তাই ক্রেতাকেও জমি বা ফ্ল্যাট কেনার আগে আইন সম্পর্কে জানতে হবে। তাই কারও দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে তাড়াহুড়া করে কেনার চুক্তি করা উচিত হবে না। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বা যে ব্যক্তি থেকে কিনছেন, তাঁর বা তাঁদের সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি জমির দলিলপত্র ও চুক্তিপত্রগুলো একজন আইনজীবীকে দেখিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট বা জমি বুকিং দেওয়া ভালো।’
ফ্ল্যাট বা জমি কেনার ক্ষেত্রে সবার আগে দরকার সচেতনতা—এমন মতামতের সঙ্গে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন তানজিম আল ইসলাম।
ফ্ল্যাট কেনার আগে যাচাই করা
ভূমি অফিসে গিয়ে জমির তল্লাশি দিয়ে জমির মালিকানা ও দখলদার সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এতে করে ফ্ল্যাটের জমির দলিল সঠিক কি না, তা জানা যায়। যে প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন, তাঁর মালিকানা আছে কি না, ঋণের জন্য ফ্ল্যাটটি কোনো ব্যাংকের কাছে বন্ধক আছে কি না, যে কোম্পানির কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের সরকারি অনুমোদন এবং রাজউক অনুমোদিত প্ল্যান আছে কি না—এসব তথ্য অবশ্যই জানতে হবে।
এ ছাড়া ফ্ল্যাট কেনাবেচা–সংক্রান্ত সব শর্ত ভালো করে বুঝে ও দেখে নিতে হবে। কেনার আগে একটু সতর্কতা অবলম্বন করলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এরপরও কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে ‘রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০’-এর সাহায্য নিতে পারবেন। যখন আপনি ফ্ল্যাট কেনার উদ্যোগ নিচ্ছেন, তখনই আইনি সহায়তায় চুক্তি করতে পারেন।
চুক্তিতে স্পষ্টভাবে ফ্ল্যাট কেনার শর্তগুলো, ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণ, ফ্ল্যাটের অনুমোদিত নকশা এবং ক্রেতা যদি কোনো উন্নত মানের সরঞ্জাম ব্যবহার করতে চান, তা নিয়ে দুই পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি—এ বিষয়গুলো উল্লেখ থাকতে হবে।
উপরিউক্ত যেকোনো বিষয় আবাসন নির্মাতা ক্রেতাকে দেখাতে এবং তা দিতে বাধ্য থাকবেন। মনে রাখতে হবে, শর্তের বাইরে অতিরিক্ত কোনো অর্থ দিতে ক্রেতা বাধ্য নন। সুতরাং ফ্ল্যাট কেনার সময় এই বিষয়গুলো উল্লেখ করে চুক্তিতে সই করতে হবে। কারণ, একবার চুক্তি হয়ে গেলে, তা থেকে বের হওয়া অনেক ঝামেলার।
আইনের সাহায্য নেবেন কখন
চুক্তি অনুযায়ী ফ্ল্যাট বুঝে না পেলে প্রথমে নিজেদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করবেন। সমাধান না হলে বিষয়টি ‘সালিস আইন ২০০১’ মোতাবেক সালিসি ট্রাইব্যুনালের শরণাপন্ন হতে হবে। সালিসি ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করবেন। যদি ব্যর্থ হন, সে ক্ষেত্রে যেকোনো পক্ষ বিবদমান বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত আদালতে মামলাও করতে পারবে। ওই আইনের বিধিবিধান লঙ্ঘন করলে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
জমি কেনার আগে প্রস্তুতি
প্রথমেই প্রস্তাবিত জমিটি সরেজমিনে দেখতে হবে। সংলগ্ন জমির মালিক বা এলাকাবাসীর কাছ থেকে জমির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। বিক্রেতার কাছ থেকে তাঁর মালিকানার প্রমাণস্বরূপ দলিলাদি ও অন্য কাগজপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি চেয়ে নিতে হবে। জমির দলিল, ওয়ারিশ সনদ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), সিএস/এসএ/আরএস/মহানগর/মিউটেশন পর্চা, ডিসিআর, খাজনার দাখিলা ইত্যাদির ফটোকপি সংগ্রহের চেষ্টা করতে হবে। তহশিল অফিসে কর্মরত কারও থেকে কাগজপত্র যাচাইয়ের জন্য সহায়তা নিতে পারেন। কারণ, জমির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য কেবল তহশিল অফিস থেকেই পেতে পারেন।
জমিটির কাগজপত্র যাচাইয়ে সন্তুষ্ট হয়ে কেনার বিষয়ে মনস্থির করলে বা বায়না করলে আপনার নাম, ঠিকানা, জমির দাগ-খতিয়ান উল্লেখ করে জমিতে একটি সাইনবোর্ড দিন। একই সঙ্গে পত্রিকায় ছোট আকারের হলেও একটি বিজ্ঞাপন দিন। এতে পরে কোনো সমস্যা হলেও আপনি আইনগত সুবিধা পাবেন। তা ছাড়া এই জমির অন্য কোনো দাবিদার বা ওয়ারিশ থাকলে, মামলা-মোকদ্দমাসহ অন্য কোনো সমস্যা থাকলে, তা প্রকাশিত হবে এবং আপনি ভবিষ্যতের একটি স্থায়ী ও জটিল সমস্যা থেকে রক্ষা পাবেন।
সাম্প্রতিক কমেন্ট